আলাপন I তুমি থাকবে কোথায়, মেয়ে?
ছবি দেখতে দেখতে আর সেসব নিয়ে পড়তে পড়তে ছবির প্রেমে পড়া কিশোরীটি ভর্তি হয়ে গেলেন ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটে। পড়লেন চারুকলা নিয়ে। শিখলেন উডকাট। কিন্তু তাঁর প্রেমকে গুছিয়ে রাখলেন আনন্দসঙ্গী করে। আর নিজেকে ছড়িয়ে দিলেন সৃষ্টির বর্ণময় ভুবনে। পাদপ্রদীপের আলো এড়িয়ে চলা এই নিভৃতচারীর শিল্পীজীবন সন্ধান করেছেন শেখ সাইফুর রহমান
ভারত ভাগের বছর না ঘুরতেই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের হাত ধরে শুরু ঢাকায় চারুকলা নিয়ে পড়াশোনার ব্যবস্থা। তাঁর আটচল্লিশের এই উদ্যোগে হাত মেলান কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ, আনওয়ারুল হক, খাজা শফিক আহমেদ, হাবিবুর রহমানের মতো কিংবদন্তিরা। তখন, সেই পঞ্চাশের দশকে, তত দিনে সবে তিনটি ব্যাচ চলছে, বগুড়া থেকে একটি মেয়ে বাবার হাত ধরে ঢাকায় আসছেন আঁককষার উচ্চতর পাঠ নিতে। এ দৃশ্য আজকের মস্তিষ্কে কল্পনা করা যাবে না, সময়টাই তো ছিল কঠিন। বাবা বাদ সাধেননি। তবে তাঁকে ইন্টারভিউয়ে খোদ শিল্পাচার্য জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘তুমি থাকবে কোথায়, মেয়ে? এখানে তো সব বড়লোকের মেয়েরা গাড়ি করে আসে। একটু-আধটু আঁকাআঁকি করে। তারপর চলে যায়।’ এমন ইন্ট্রোডাকশনে মেয়েটি একটু থতমত খেয়ে যান। কিন্তু পিছপা হওয়ার পাত্র তো নন। পষ্ট জানিয়ে দেন— আগে ভর্তি হই, তারপর ব্যবস্থা একটা করবো।
— কোথায় ব্যবস্থা করবে?
— এত বড় ঢাকা শহর, কোথাও না কোথাও হবে। আমি ঠিক করে নেবো।
সেই আত্মবিশ্বাসকে টলাতে পারেননি শিল্পাচার্য। ফলে চারুকলায় পেইন্টিং নিয়ে ভর্তি হয়ে গেলেন। শুরু হলো এখানে-ওখানে করে থাকা। চলতে লাগল পড়াশোনা। তারপর সেই জয়নুল আবেদিন স্যারই একদিন সস্নেহে তাঁকে বললেন, তোমার তো দেখছি বেশ তেজ আছে, মেয়ে!
অনেক কিছুই আজ আর সেভাবে স্মরণ করতে পারেন না অশীতিপর সুফিয়া শহীদ। তবে পুরোনো সেই দিনের সবকিছুই যে সময়ের অতলে হারিয়ে গেছে, তা-ও নয়। বরং স্মৃতির সিন্দুক থেকে বের করে এনেছেন অবিন্যস্ত অথচ দুর্লভ সব মণিকাঞ্চন। বোশেখের এক সকালে কথা হচ্ছিল আওরঙ্গজেব রোডে, তাঁর বাড়িতে বসে। আলাপনের মধ্যে খেই ধরিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁর দুই মেয়ে সাবরিনা ও সুমায়রা।
আমরা ফিরে যাই চারুকলার দিনে। ঢাকার সঙ্গে তাঁর যোগটা ছেলেবেলা থেকেই। বাবার বড় মেয়ে। একটু ডানপিটে। ঢাকায় আসেন আগেই। কামরুন্নেসা কলেজ থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপরই ভর্তি হয়ে যান চারুকলায়। চতুর্থ ব্যাচে হাতে গোনা কয়েকজন মেয়ে। সবার কথা আজ আর সেভাবে মনে নেই। ছবি এবং তা নিয়ে লেখাপড়ার আগ্রহ থেকেই ছবি আঁকা শিখতে আসা সুফিয়ার। পাশাপাশি নিজে আঁকতেও পারতেন। চারুকলার পাঠ তাঁকে আরও শাণিত করে।
সুফিয়া শহীদের ‘আবেদিন স্যার’ তাঁর কাছে ছিলেন এক স্বপ্নের মানুষ। ময়মনসিংহের ভাষায় কথা বলতেন। একটু জোরে কথা বললেই বলতেন, ‘গন্ডগোল করবা না; বাইর কইরা দিমু, মাইয়্যা।’
স্মৃতিচারণায় যেন ফিরে পান উচ্ছল সেসব দিন। এরই মধ্যে তাঁর মেয়ে সাবরিনা কয়েকটি পুরোনো ছবি নিয়ে আসেন। সোৎসাহে দেখাতে থাকেন ছবির মানুষদের। অনেকে নেই, অনেকেই আছেন।
হাশেম খান তাঁর অগ্রজ। আর রফিকুন্নবী এক বছরের জ্যেষ্ঠ হলেও তাঁর সঙ্গে একই ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। তবে জয়নুল আবেদিন ছাড়াও সফিউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়ার মতো প্রবাদপ্রতিম আচার্যদের কাছে শেখার যে আনন্দ, তা আজও সুফিয়া শহীদকে আবিষ্ট করে। স্যাররা কেবল শেখাতেন তা নয়, ছাত্রদের সঙ্গে নানা উপলক্ষ উদযাপনও করতেন। এর মধ্যে তাঁর স্মৃতিতে উজ্জ্বল পিকনিকের কথা। সে সময়ে তা বেশ হইচই করে হতো। স্যাররা যেতেন তাঁদের সঙ্গে একই বাসে। সম্পর্কের সেই উষ্ণতা তিনি অনুভব করেন আজও।
বাহান্ন থেকে একাত্তর— নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন নানা আন্দোলনে। বাহান্নয় স্কুলে পড়া অবস্থায় আন্দোলনের অংশ হয়ে গেলেন। পোস্টার লিখেছেন। রিকশা চেপে দেয়ালে দেয়ালে সেসব পোস্টার লাগিয়েছেন। বললেন, সে কাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহায্য করেছে রিকশাওয়ালাও।
একাত্তরের নানা ঘটনা বিক্ষিপ্তভাবে হলেও তিনি মনে করতে পারেন। তাঁরা সেই সময়ে ভাড়া থাকতেন তাজউদ্দীন আহমদের বাড়িতে। ‘আমার পানচিনির দিন জেলে গেলেন তাজউদ্দীন। আর আমার ছেলে যেদিন হয়, সেদিন ছাড়া পান। তাই ছেলের নাম মুক্তি রাখতে বলেছিলেন তিনি।’
বঙ্গবন্ধুরও নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল ওই বাড়িতে। স্নেহ করতেন। রান্না করে খাইয়েছেনও। এসবই তাঁর পরম পাওয়া।
সুফিয়া শহীদের জন্ম বগুড়ায়, ১৯৩৭ সালে। বাবা খয়রাত আলী তালুকদার ছিলেন জমিদার। ১৩ সন্তানের জ্যেষ্ঠতম হওয়ায় আদরের ছিলেন। চারুকলার শিক্ষা তাঁকে শিল্পের নানা শাখায় বিচরণে উদ্বুদ্ধ করেছে। আঁকাটা ছিল তাঁর প্রাণের কাছাকাছি। এঁকেছেন নিজের আনন্দের জন্য। প্রদর্শনী, বিক্রি— এসবের জন্য নয়। সেসব নিয়ে পড়েছেন; দেখেছেন বিস্তর— কি দেশে কি বিদেশে। ভ্যান গঘ তাঁকে আজও সমান আলোড়িত করে। প্রাণিত হয়েছেন সমরজিৎ রায়চৌধুরী, সফিউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়ার সৃষ্টিতে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত নিয়মিত প্রদর্শনীতে গিয়ে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের কাজ দেখেছেন। শরীর এখন আর তাঁকে সেই স্বাধীনতা উপভোগের সুযোগ দেয় না। জীবন এখন চার দেয়ালের মধ্যে নানা দৃশ্যেই আবর্তিত। তাতে সঙ্গী হয় স্মৃতির মিছিল।
চারুকলার ডিগ্রি শেষ করেই তিনি যোগ দেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনে (বিসিক)। পটুয়া কামরুল হাসানের স্বপ্নপ্রকল্প। ডিজাইন সেন্টারে তিনি কাজ শুরু করেন পুতুল নকশা ও তৈরি বিভাগে। কিন্তু বেশি দিন স্থায়ী হননি সেখানে। কারণ, এই ডিজাইন সেন্টার দেখতে এসে কামরুল হাসানের বন্ধু শিল্পপতি আব্দুস শহীদের নজরে পড়ে যান। বিয়ে হয়ে যায় পরের বছর। মাধ্যম সেই কামরুল হাসান।
বিয়ের পর নিজে আর্ট স্কুল ‘কারুকল্প’ চালু করেন। শুরু করেন তেলরঙ আর বাটিক শেখানো। পাশাপাশি পুতুল তৈরি তো ছিলই। এরই মধ্যে বৃত্তি নিয়ে তিনি লন্ডনে গিয়েছেন সেখানকার বাংলাদেশিদের পুতুল তৈরির ওপর প্রশিক্ষণ দিতে এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠান তৈরির জন্য। ফিরে শিক্ষকতা করেছেন উদয়ন স্কুল ও সানবিমসে। কাজ করেছেন বাঁচতে শেখা’র সঙ্গে। নিজের প্রতিষ্ঠান সপ্তর্ষি গড়েছেন। আর এই প্রতিষ্ঠানের শাড়ি, পাঞ্জাবি, বাচ্চাদের পোশাক সরবরাহ করেছেন আড়ংয়ে। জামদানির প্রতি তাঁর অনুরাগ প্রগাঢ়। বিদেশেও প্রদর্শনী করেছেন নিজের সংগ্রহের। প্রয়াত নীলিমা ইব্রাহিম মহিলা সমিতির প্রেসিডেন্ট থাকার সময় তিনি ছিলেন এর একজন সক্রিয় সদস্য। প্রকৃতিপ্রেমী সুফিয়ার সঙ্গে এখনো সম্পৃক্ততা রয়েছে বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটির।
তরুণ শিল্পীদের উৎসাহিত করেছেন সব সময়েই। বহুতল ভবন হওয়ার আগে নিজের বাড়িকেই গ্যালারি বানিয়ে প্রদর্শনী করার সুযোগ করে দিতেন।
কালের নিয়মে দিনগুলো কারোরই সোনার খাঁচায় থাকে না। সুফিয়া শহীদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে আনন্দ আর গৌরবের স্মৃতিই তাঁর জীবনকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
sksaifurrahman@gmail.com
ছবি: অঙ্কুর রায় ও সুফিয়া শহীদের সংগ্রহ