এডিটরস কলাম I ইগো থাকুক সুপথে
‘ইগো’কে যে কেবল নিন্দনীয়ভাবে সমাজে দেখা হয়, তা ঠিক নয়। এটি ভালো ও মন্দ দুই-ই হতে পারে। ইডের ওপর যার নিয়ন্ত্রণ যথাযথ, তার ইগো ভালো; আর বিপরীতটি হলে মন্দ। বলতে চাইছি, ভালো মানুষ হয়ে উঠতে চাইলে ইডের ওপর সঠিক নিয়ন্ত্রণ জরুরি। এই যে সংযমের কথা আমরা বলি, এর লক্ষ্য সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা
মানুষের স্বভাব কিংবা মন বোঝাতে গিয়ে প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে আমরা ‘ইগো’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। শব্দটি লাতিন হলেও এর উৎস গ্রিক, যার অর্থ ‘আমি’। লাতিনে ‘আমি নিজে’। ইংরেজিতে ‘সেলফ’, ‘আইডেনটিটি’; বাংলায় ‘অহম’, ‘অহং’, ‘অহংবোধ’ ‘স্বাতন্ত্র্যবোধ’, ‘আত্মমর্যাদার অনুভূতি’ ইত্যাদি। প্রসারিত অর্থে ব্যক্তির চিন্তা, অনুভব ও ইচ্ছা, অনন্যতাবোধ। প্রচলিত যে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে শব্দটির সামাজিক অর্থ প্রতিষ্ঠিত, তা মোটেও প্রশংসাবাচক নয়। বরং নিন্দাসূচক। এই মর্মে যে লোকটির মধ্যে অন্যায় জেদ রয়েছে, অন্যের (এমনকি নিজেরও) ক্ষতি হলেও তিনি যা চান, তা-ই হতে হবে।
কিন্তু আচরণবিদ্যা কিংবা মনোবিজ্ঞানে ‘ইগো’র অর্থ ভিন্ন। সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯) উত্থাপিত মনঃসমীক্ষণতত্ত্বে (১৯২০-২৩) ব্যক্তিত্বকাঠামোর তিনটি স্তর ও উপাদানের দ্বিতীয়টি হলো এই ‘ইগো’। প্রথমটি ‘ইড’ যা অসংগঠিত ও জৈবিক, তৃতীয়টি ‘সুপার ইগো’। এটি সমাজনির্দেশিত ও নৈতিক। ‘ইগো’ বাস্তবমুখী ও মনস্তাত্ত্বিক। ইড হচ্ছে ব্যক্তিত্বের মৌল সত্তা, যা ধারণ করে জন্মসূত্রে পাওয়া মানসিক বৈশিষ্ট্যগুলো। আমরা যাকে সহজাত প্রবৃত্তি বলি, তা ইডেরই অংশ। ইড হলো ‘বুদ্ধিহীন অবিবেচক শিশু’; সে যখন যা চায়, তখন তা পেলে তার উত্তেজনা প্রশমিত হয়। বাস্তব জগতে এটি সম্ভব কি না, সম্ভব হলে তা উচিত কি অনুচিত— এসবে তার কিছু যায়-আসে না। ইগোর কাজ ইডকে নিয়ন্ত্রণ ও চালিত করা। ব্যক্তির আচরণগত যে ভারসাম্যের মধ্য দিয়ে মানবসমাজ সুশৃঙ্খলভাবে চলছে ও বিকশিত হচ্ছে, তার কারণ ইডের ওপর ইগোর নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ ইগো হচ্ছে ব্যক্তিত্বের প্রশাসনিক শাখা। কারণ, এটি বলে দেয় কোন কোন প্রবৃত্তি ও আকাক্সক্ষা কীভাবে চরিতার্থ ও তৃপ্ত হতে পারে। সুপার-ইগো ব্যক্তিত্বের সর্বশেষ সত্তাস্তর। প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ ইডের ইচ্ছাকে সমর্থন করে কি না, তার বিচার-বিশ্লেষণ সুপার-ইগোর কাজ। পুরস্কার ও শাস্তি থেকে শিশু সামাজিক মূল্যবোধ আয়ত্ত করে। এতে সে এমন এক ধারণা পায়, যেখানে অন্যায় করলে তার মধ্যে একটা অপরাধবোধ জন্ম নেয় এবং পারিবারিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে আত্মনিয়ন্ত্রণের বোধ ও অভ্যাস গড়ে ওঠে। দেখা যাচ্ছে, ইগোর বিচার্য বাস্তবতা আর সুপার-ইগোর নৈতিক আদর্শ। সুপার-ইগোর মূল কাজ তিনটি: ইডের আবেগকে শমিত করা, বিশেষত যৌনাবেগ ও আক্রমণাত্মক ইচ্ছা যা সমাজে নিন্দিত; ইগোর মধ্যে বাস্তবতার জায়গায় নৈতিকতার বোধ জাগিয়ে তোলা এবং তাতে পূর্ণতা আনার চেষ্টা করা অর্থাৎ মানবীয় আচরণগুলো যথাসম্ভব মার্জিত করে তোলা। ইড, ইগো ও সুপার-ইগো কাজ করে একসঙ্গে, ইগোর নেতৃত্বে, সমন্বিতভাবে।
বোঝা যাচ্ছে, ‘ইগো’কে যে কেবল নিন্দনীয়ভাবে সমাজে দেখা হয়, তা ঠিক নয়। এটি ভালো ও মন্দ দুই-ই হতে পারে। ইডের ওপর যার নিয়ন্ত্রণ যথাযথ, তার ইগো ভালো; আর বিপরীতটি হলে মন্দ। বলতে চাইছি, ভালো মানুষ হয়ে উঠতে চাইলে ইডের ওপর সঠিক নিয়ন্ত্রণ জরুরি। এই যে সংযমের কথা আমরা বলি, এর লক্ষ্য সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। লোভ, কাম, হিংসা ইত্যাদি সামলে রাখতে পারলে এটা সম্ভব। ইড নামের ‘বুদ্ধিহীন অবিবেচক শিশু’কে নিয়ন্ত্রণের কাজটি যদি ইগো সঠিকভাবে করতে পারে, তাহলে পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ হবেই।
আমাদের প্রত্যেকের ইগো রয়েছে, কিন্তু ইডকে সব সময় আমরা কি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি? সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারি? এই যে পবিত্র রমজান, এটা হলো সেই অনুশীলনের মাস, যখন প্রতি মুহূর্তে আমরা সামলে নিতে চাই ইডকে, ইগোর নেতৃত্বে। মনের ওপর নিয়ন্ত্রণই আসল কথা, যা সম্ভব হলে নিজেকে সুপথে চালিত করা যায়। সংযমের এই দিনগুলো আমাদের সেই শিক্ষা দেয়।
সুতরাং আসুন, ইগোকে বলি যেন সে ইডকে ঠিকমতো সামলে নেয়; সুপার-ইগোকে বলি, তুমি ভালো ইগোর সঙ্গে থাকো, এমনভাবে, যাতে ইড বিপজ্জনক হয়ে না ওঠে। ব্যক্তির মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের মধ্য দিয়ে যাতে নৈতিক ও দায়িত্বশীল সমাজ গড়ে তোলা যায়।