skip to Main Content

এডিটর’স কলাম I এসো, পারস্পরিক হই

শুধু নিজের অস্তিত্বরক্ষা মানবজীবনের অভিপ্রায় হতে পারে না। এটা ঠিক, দিন যত যাচ্ছে, জীবন তত হয়ে উঠছে যান্ত্রিক ও জটিল। জীবিকার তাগিদে সবাই ছুটছে। নিজেকে, পরিবারকে একটু নিশ্চিন্ত আর ভালো রাখার জন্য

জার্মান কথাসাহিত্যিক ফ্রানৎস কাফকার (১৮৮৩-১৯২৪) বিখ্যাত উপন্যাস ‘মেটামরফোসিস’ আমাদের মধ্যে অনেকেই পড়েছেন। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্রেগর সামসাকে ভুলবেন না কেউ। এক সকালে ঘুম ভাঙার পর গ্রেগর নিজেকে আরশোলারূপে আবিষ্কার করে। আরশোলা যেমন উল্টে গেলে সাধারণত আর আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারে না, তার সেই দশা হয়েছে এবং বিছানা থেকে উঠতে না পেরে সে নিজের দুর্বিষহ জীবনের ফ্ল্যাশব্যাকে প্রবেশ করে : সেই সকাল থেকে রাত অব্দি সে কোম্পানির টার্গেটমাফিক কাজ করে ফিরে আসে নিজের ঘরটায়। বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিনের এই অবশ্যকর্তব্য থেকে তার মুক্তি নেই। এই বন্দিদশায় মানুষ হিসেবে গ্রেগর তার অনুভূতিগুলো হারিয়ে ফেলেছে, ফলে সে হয়ে পড়েছে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, এমনকি নিজের থেকেও বিচ্ছিন্ন। অথচ সমাজকাঠামোর মধ্যেই সে রয়েছে। আর নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই তার এই পরিশ্রম।
এই জীবন কি আমরা চাই? বেঁচে থাকার জন্যই তো আমাদের কাজ করে যেতে হয়, কিন্তু তাতে যদি মানবিক আবেগগুলোয় মরচে ধরে এবং নষ্ট হয়ে যায়, তবে সে জীবন আদতে অর্থহীন। শুধু নিজের অস্তিত্বরক্ষা মানবজীবনের অভিপ্রায় হতে পারে না। এটা ঠিক, দিন যত যাচ্ছে, জীবন তত হয়ে উঠছে যান্ত্রিক ও জটিল। জীবিকার তাগিদে সবাই ছুটছে। নিজেকে, পরিবারকে একটু নিশ্চিন্ত আর ভালো রাখার জন্য। ছুটতে ছুটতে আমরা কোথাও কি পৌঁছতে পারছি? বরং বন্দি হয়ে পড়ছি প্রয়োজনের বৃত্তে। এক চাহিদা মিটে গেলে আরেক চাহিদা এসে পড়ে, এক শূন্যতা পূরণের পর নতুন এক শূন্যতার মুখোমুখি হই। এটা এমন এক চক্র, যা অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে, এমনকি নিজের থেকেও। ফলে একই সমাজে বসবাস করেও আমরা একে অন্যের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে উঠি। আমাদের দুদন্ড ফুরসত নেই নিজেকে অন্যের কাছে বোধগম্য করে তোলার; নিজেকেই-বা কতটুকু বুঝি? সে সময় আছে আমাদের? এই যে কর্মব্যস্ত প্রতিটি দিন পার করে সন্ধ্যায় ক্লান্ত দেহমন নিয়ে বাড়ি ফিরে পরিবারের প্রতি বাঁধাধরা কিছু কর্তব্য পালনের পর ঘুমিয়ে পড়া—এর মধ্যে প্রীতিকর সময় কিংবা মানসিক স্পেস কেমন করে পাওয়া যাবে? রোজগারের জন্য পরিশ্রম, পরিবারের জন্য কর্তব্য এবং শরীর ঠিক রাখার জন্য খাদ্য আর বিশ্রাম—এই তিনটি ফ্রেমের মধ্যে আমরা আটকে আছি। অন্যের জন্য ভাবার সময় আমাদের আছে কি?
আছে। দেখুন, মেটামরফোসিসে গ্রেগরের কোনো অবসর নেই, উৎসব নেই। জীবনের যত জটিলতা, জীবিকার যত সংগ্রাম আর কর্তব্যের যত চাপ থাকুক—আমাদের কিছু উপলক্ষ আছে, উৎসব আছে। বছরজুড়ে যে স্বজনেরা দূরে থাকে, তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ আছে। আমাদের উৎসবগুলো সেই পরিসর গড়ে দেয়। এই যে ঈদ, এটা কি কেবল নতুন পোশাক আর সুস্বাদু খাবারে সীমাবদ্ধ? তা তো নয়। এ হলো পরিবারের সঙ্গে, আত্মীয়ের সঙ্গে আর সমাজের কাছের মানুষজনের সঙ্গে ফের ঘনিষ্ঠ হওয়ার উপলক্ষ। এর মধ্য্য দিয়ে আমরা নিজেদেরই খুঁজে পাই। সারা বছরের কর্মব্যস্ত ব্যক্তি আমি থেকে সমগ্র আমিতে রূপান্তরিত হই তখন। আমাদের বিচ্ছিন্নতা ঘুচে যায়। অন্যের থেকে, এমনকি নিজের থেকেও। আমরা সেজে উঠি, হয়ে উঠতে চাই আরও সুন্দর। সবার মধ্যে নিজেকে অনুভব করার জন্য। উৎসব যেহেতু প্রতিদিন হয় না, তাই এর একটা অর্থ ও সৌন্দর্য আছে। সবচেয়ে বেশি আছে বাস্তবের রূঢ়তা থেকে মুক্তির আনন্দদায়ক আস্বাদ। সেটাই তো আমরা পরস্পর ভাগ করে নিতে চাই।
কিন্তু ঈদ উৎসব উদ্যাপনের পর আমরা যে যার কর্মময় জীবনে ফিরে যাব। আবার সেই সকাল-সন্ধ্যার ব্যস্ততা শেষে নিজ গৃহে ফিরে যাওয়ার বৃত্তে ঢুকে পড়া—আরেকটি উৎসব পর্যন্ত সমাজের আর সব নিকটজনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। কিন্তু মাসে অন্তত একটা সাপ্তাহিক ছুটিতে এই বৃত্ত ভেঙে দিয়ে পরস্পরের হয়ে ওঠার চেষ্টা তো করতে পারি! তাতে বিচ্ছিন্নতা যেমন ঘুচবে, ক্লান্তি আর একঘেয়েমিও কাটবে। সেই গ্রেগরের মতো আত্মপলায়নের ফ্ল্যাশব্যাকে প্রবেশ করতে হবে না, দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হবে না এই ভেবে যে—জীবনটা পাহাড়ে পাথর ঠেলতে ঠেলতেই শেষ হয়ে গেল!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top