skip to Main Content

স্বাদশেকড় I আচার

মুখরোচক। এর উদ্ভব ও ব্যবহারের সঙ্গে রয়েছে সমুদ্রযাত্রা ও খাবার সংরক্ষণের সম্পর্ক। কালে কালে এটি নানা দেশে খাদ্য-সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে

‘আচার’ শব্দটি বাংলা নয়, ফারসি। খাবারটিও দেশি না। তবে এখন তা বাঙালির রসনায় প্রায় নিয়মিত হয়ে উঠেছে। প্রাচীন খাবারের মধ্যে যেসব সমকালেও টিকে আছে, আচার সেগুলোর মধ্যে একটি। বিচিত্র স্বাদই দীর্ঘকাল ধরে এর জনপ্রিয়তা টিকিয়ে রেখেছে। আচারের ইতিহাস খুব আদিম নয়; বরং প্রাচীন। তবে একাল ও সেকালের আচার তৈরির উদ্দেশ্য এক ছিল না। মূলত খাবার সংরক্ষণের তাগিদে খাদ্যদ্রব্যকে যে পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হতো, সেটিই পরবর্তীকালে আচার নাম ধারণ করেছে। তখন ফলমূল ও বিভিন্ন সবজির পচনরোধে নানান কৌশল অবলম্বন করতে হতো। যাযাবরবৃত্তির অস্থায়ী আবাসন নিত্য পরিবর্তনের কারণে কিংবা দীর্ঘসমুদ্র পাড়ি দেওয়ার তাগিদে খাদ্যদ্রব্যকে সংরক্ষণের প্রয়োজন হতো। নৃবিজ্ঞানীরা মত দিয়েছেন, মূলত খাবার সংরক্ষণের প্রয়োজন থেকেই আচার তৈরির উপায় উদ্ভাবন করা হয়। বিভিন্ন গবেষণা ও ধারণার ভিত্তিতে বলা চলে, এই পদটির উদ্ভব ঘটে মোটামুটি চার হাজার বছর আগে। উৎপত্তিস্থল নিয়েও মতভেদ আছে। কিছু ধারণা অনুযায়ী মানুষ আচার খাওয়া শুরু করেছিল ২৪০০ খ্রিস্টপূর্বে, মেসোপটেমিয়ায়। সেই সভ্যতায় ফলকে আচার বানিয়ে সংরক্ষণ করা হতো। ২০৩০ খ্রিস্টপূর্বে তারা শসা এভাবে মজুত করেছিল বলে জানা যায়। ধারণা করা হয়, এটিই পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন আচার। তাদের ছিল নিজস্ব কেতা। সেই ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি অনুসরণে গাজর, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, বেগুন, টমেটো, বরবটি ইত্যাদির আচার তৈরি করা যায় এখনো।
প্রাচীন রোমে জুলিয়াস সিজারের আমলে আচারের প্রচলন ছিল বলে তথ্য মেলে। তিনি তার সেনাবাহিনীর শারীরিক শক্তি বাড়াতে খাওয়াতেন পদটি। তা ছাড়া খ্রিস্টপূর্ব ৫০ সালে মিসরের রানির ক্লিওপেট্রার যুগে আচার খাওয়া হতো বলে অভিমত দিয়েছেন ইতিহাসবিদেরা। তার ছিল রূপের খ্যাতি। রানির চোখধাঁধানো রূপে মোহিত হয়েছিলেন তৎকালীন রাজ-রাজড়া। ঈর্ষান্বিত নারী এবং কৌতূহলী পুরুষ—সবাই খোঁজ করেছেন তার রূপের রহস্য। আচারের ইতিহাস রচয়িতাদের দাবি, ক্লিওপেট্রার এই সৌন্দর্যের চাবিকাঠি নিহিত ছিল ওই খাবারেই। নিয়মিত বিভিন্ন স্বাদের আচার খেতেন এই নারী। তারও ধারণা ছিল যে নিজের এই ভুবনমোহিনী রূপের একমাত্র কারণ হলো এই পদ। তাই রূপচর্চার তাগিদেই নিয়মিত খাবারটি খেতেন ক্লিওপেট্রা।
কথিত আছে, আচার না থাকলে নাকি আমেরিকা আবিষ্কারই হতো না। ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা অভিযানে বেরিয়েছিলেন, তখন তিনি তার নাবিকদেরকে রেশন হিসেবে দিয়েছিলেন আচার। এর পেছনে অবশ্য একটি কারণ ছিল। সেই আচার ছিল মূলত ওষুধ। সমুদ্রযাত্রায় স্কার্ভি রোগে আক্রান্ত হতো নাবিকেরা। তখন সেটি ছিল মারণরোগ। মৃত্যু ঠেকাতে প্রয়োজন ছিল ভিটামিন সির নিয়মিত জোগান। তা নিশ্চিত করতেই নাবিকদের হাতে কলম্বাস তুলে দিয়েছিলেন আচার। সেসব ছিল মূলত সবজির। গবেষকেরা তেমনটাই ধারণা করেছেন। বিভিন্ন ঋতুতে যেসব সবজি পাওয়া যায়, তা দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে খাওয়ার জন্য আচার বানিয়ে রাখতেন সে যুগের পাকা রাঁধুনিরা।
সপ্তদশ শতাব্দীতে আচার তৈরির গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান ছিল শুলফা। এটি মূলত মৌরি জাতের একধরনের গুল্ম। ইট ইন্দোনেশিয়া থেকে পশ্চিম ইউরোপে গিয়েছিল নবম শতাব্দীতে। যুক্তরাষ্ট্রে আচার খাওয়ার প্রচলন করেছিল ডাচ চাষিরা। ১৬৫৯ সাল পর্যন্ত তারা শসার আচার তৈরি করত। সেগুলো ব্যারলে করে বিক্রি হতো।
আরেকটি মতে, আচারের উৎপত্তি হয়েছে ভারত উপমহাদেশে। দিনক্ষণ জানা যায়নি। এমনও হতে পারে, পদটির উৎপত্তি পশ্চিম ভারতে। আগেই বলা হয়েছে, বণিক ও যাযাবর গোষ্ঠীর মধ্যে খাবার সংরক্ষণের চল ও তাগিদ বেশি ছিল। প্রাচীন পশ্চিম ভারতে এই দুই শ্রেণির বাহুল্য চোখে পড়ে। আরেকটি মতে, বাংলায় আচার প্রবেশ করে সুলতানি আমলে। মানসিংহের হাত ধরে। এর মূল স্বাদ টক হওয়ায় অনেকেই এই খাবারকে ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিণি ঘরানার খাদ্য ভাবেন। কিন্তু বাঙালি রসনার গোড়াতেই রয়েছে টক। চর্যাপদে এই জাতির খাদ্যতালিকায় তেঁতুলের বয়ান মেলে। তবে এই অম্লীয় ফলটি দিয়ে বাঙালি হয়তো আচার নয়, বরং চাটনি তৈরি করেছিল। আচার ও চাটনির মধ্যে ফারাক আছে। চাটনি হয় ফল কিংবা সবজির টুকরা দিয়ে। অন্যদিকে আস্ত ফল বা সবজি দিয়েই আচার হয়। টুকরা না করলেও চলে।
ঠাকুরবাড়ির হেঁশেল ও খাওয়ার ঘরেও ছিল আচারের উপস্থিতি। রবীন্দ্রনাথের বড় দিদি সৌদামিনী বিভিন্ন পদের পাশাপাশি এই পদও বানাতেন বেশ। তার হাতে তৈরি হতো জারক লেবু, আমসত্ত্ব, আমসি, এঁচোড়ের আচার ও কাসুন্দি। পরে এসব বানানোর দায়িত্ব বর্তায় নীপময়ী দেবীর ওপর। তা ছাড়া সুবীরেন্দ্রনাথের স্ত্রী পূর্ণিমা ঠাকুরের আচারেরও খ্যাতি ছিল।
খাবারটির গুণাগুণ ও ইতিহাস মনে রাখতে আমেরিকায় প্রতি ১৪ নভেম্বর পালিত হয় আচার দিবস। শুরু হয়েছে ২০০১ সাল থেকে। এদিন সবাই খাবারের সঙ্গে আচার খায়। একে-অন্যকে তা উপহারও দেয়। বাংলাদেশে প্রতি বৈশাখ মাসেই আচার তৈরির ধুম পড়ে। গ্রামে চালার ওপর শুকাতে দেওয়া হয় আমের ফালি, আমসত্ত্ব ইত্যাদি। শহরের দেয়ালে দেখা যায় নানান ফলের আচার রোদে দেওয়া। এখন শুধু ফল বা সবজিরই নয়, মাছ-মাংসেরও আচার হয়। তবে তা প্রাচীনকালের খাদ্য সংরক্ষণের তাগিদে নয়; রসনার আহ্লাদ মেটাতে।

 ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top