skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I ইলিশ বৈঠক

বৈশাখ এলেই ইলিশ নিয়ে কথা-কাটাকাটি শুরু হয়। মাছটির দরদাম ছাড়া এর অন্যান্য বিষয় নিয়ে অনেকের জানার পরিধি হয়তো কম। এর নামকরণ, নামের অর্থ, প্রাপ্তিস্থান, স্বাদের ভিন্নতার কারণ, পুষ্টিমান—এসব নিয়ে রয়েছে বাহারি তথ্য। পরাবাস্তব এক সাক্ষাৎকারে সেসবের ফিরিস্তি তুলে এনেছেন শিবলী আহমেদ

ক্যানভাস: আপনার নাম?
ইলিশ: এ আবার কেমন প্রশ্ন! নাম ‘ইলিশ’, সবাই-ই তো জানে।
ক্যানভাস: না…মানে, জানতে চাইছিলাম আপনার স্থানীয় নাম। কত লোকেই তো কত নামে ডাকে…
ইলিশ: তা ঠিক। চন্দনা, জাটকা, খয়রা। চট্টগ্রামে কেউ কেউ ডাকে চিটা। কুমিল্লা ও নোয়াখালীর লোকেরা বিল্লি, খাল্লিশ, পাইটে ও সকড়ি বলে। দেশের বর্ডার পেরোলে আবার ভিন্ন নাম।
ক্যানভাস: সেগুলো কেমন?
ইলিশ: এই যেমন আসামে ডাকে হিলসা, বিহারে ইলশা, মারাঠায় পাল্লো, ওডিশায় ইলিশি। গুজরাটের লোকেরা আবার এককাঠি বেশি সরেস। তারা স্ত্রী ইলিশকে ডাকে মদেন, আর পুরুষগুলোকে পালওয়া। সিন্ধিরা ডাকে পাল্লা।
ক্যানভাস: আরেব্বাহ্! তাহলে তো আপনাকে নামে চিনতে বেশ সমস্যা হওয়ার কথা। বলি, আপনার ‘ইলিশ’ নামটিই-বা কার দেওয়া?
ইলিশ: না না। বিশেষজ্ঞরা বৈজ্ঞানিক নামেই চেনেন আমাকে। ‘হিলসা ইলিশা’। হ্যামিলটন বুকানন সাহেব ১৮২২ সালে আমার এই নামটি দেন। আমার ‘ইলিশ’ নামটি তো বেশ পুরোনো। দিগেন বর্মণের লেখা ‘ইলিশ পুরাণ’ ঘাঁটলে জানতে পারবেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে পণ্ডিত জীমূতবাহন আমার নাম রেখেছিলেন ‘ইলিশ’।
ক্যানভাস: এ নামের বিশেষ কোনো অর্থ আছে?
ইলিশ: হ্যাঁ, তা তো রয়েছেই। নামটি এসেছে সংস্কৃত থেকে। মূল শব্দটি হলো ইলীশ। সন্ধিবিচ্ছেদ করলে হয় ইল+ঈশ। ইল মানে ‘জলের মধ্যে’; আর ঈশ মানে ‘রাজা’।
ক্যানভাস: ও আচ্ছা! অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনার বাড়ি কোথায়? মানে স্থায়ী নিবাস?
ইলিশ: বাড়ি! কোথায় নেই আমি? বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে পশ্চিমে ভারত সাগর; আরব সাগর, লোহিত সাগর—সব জায়গাতেই বাস। আরব সাগরের উত্তরে ওমান ও হরমুজ প্রণালি হয়ে পশ্চিমে পারস্য উপসাগরে ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়াই। আন্দামান সাগর ও মালাক্কা প্রণালি হয়ে চীন সাগরেও আছি। শাতিল আরব, ইরান, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস, সিন্ধু, মিয়ানমারের ইরাবতী, ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীর মিঠাপানিতেও আমার দেখা পাবেন। বাংলাদেশের পদ্মা, যমুনা, মেঘনা ও কর্ণফুলী নদীতে তো আছিই।
ক্যানভাস: মানে, আপনি সাগরেও আছেন, নদীতেও আছেন। আচ্ছা, একটা সিক্রেট বলুন তো। সাগরের তুলনায় নদীর ইলিশে স্বাদ বেশি কেন?
ইলিশ: একদম সহজ বিষয়। সাগরের নোনা পানি ছেড়ে যতই নদীর উজানে যেতে থাকি, আমার শরীর থেকে ততই তেল ও লবণ ক্ষয়ে যায়। নদীর মিঠাপানিতে যত থাকি, শরীরের চর্বি ও খনিজ লবণ ততই কমে। ফলে স্বাদও বাড়ে। এ কারণেই সাগরের ইলিশে স্বাদ কম। নদীরগুলো বেশি মুখরোচক।
ক্যানভাস: কিন্তু আপনারা সাগর ছেড়ে নদীতে আসেন কেন?
ইলিশ: ডিম ছাড়তে। নোনা পানিতে ডিম নষ্ট হয়ে যায়। তাই নদীর মোহনায় আসি।
ক্যানভাস: সাগর ও নদীর ইলিশ চিনব কী করে?
ইলিশ: দেখে চিনতে হয়। নদীরগুলো বেঁটে, সাগরেরগুলো সরু ও লম্বা। নদীরগুলো বেশ চকচকে, সাগরেরগুলো খুব একটা উজ্জ্বল নয়।
ক্যানভাস: মাঝেমধ্যে ইলিশ ধরা বন্ধ রাখতে বলা হয়। তখন আপনাদের নিশ্চয়ই খুব আনন্দ হয়?
ইলিশ: তা তো হয়ই। কিন্তু আদৌ কি বন্ধ হয়? আইন অমান্য করে তো অনেকে ধরেই। আমাদের সংরক্ষণের চিন্তা তো আজ থেকে করা হচ্ছে না। বিষ্ণুধর্মসূত্রে মাছ চুরির দায়ে জরিমানার ব্যবস্থা ছিল। মনুস্মৃতিতেও দেখেছি। অশোকের পঞ্চম স্তম্ভলিপিতে দেখবেন বছরে ৫১-৭২ দিন ডিমওয়ালা মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, পৌষ মাসের শুক্লা চতুর্দশী, পূর্ণিমা, পূর্ণিমার পরদিন, অমাবস্যা ও অষ্টমীর দিন—সব মিলিয়ে বছরে ৫১ থেকে ৭২ দিন মাছ ধরা ছিল নিষিদ্ধ। এখনো আমাদের ধরার ওপর অনেক বিধিনিষেধ আরোপ হয়। সেগুলো পুরোপুরি মানলে কিন্তু আপনাদের মনুষ্য সমাজেরই মঙ্গল।
ক্যানভাস: শোনা যায়, পানি থেকে তোলার পর আপনারা নাকি আড়াই লাফেই মারা যান? এর কারণ কী?
ইলিশ: মূলত আলো ও তাপে আমরা খুব সংবেদনশীল। এগুলো খুব একটা সহ্য হয় না। তাই পানির বাইরে এলে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারি না। তা ছাড়া অন্যান্য মাছের মতো আমাদের পটকা নেই। পটকা দিয়েই তো পানিতে ভাসা ও অক্সিজেন ধরে রাখার কাজ করতে হয়। যেহেতু পটকা নেই, তাই পানি থেকে তুললে দ্রুতই মারা যাই। অবশ্য আমাদের মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম আছে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে কেউ কেউ ঠিকই ডাঙায় টিকে থাকতে পারে দীর্ঘক্ষণ। বরিশালের হিজলায় মেঘনা থেকে ধরা ইলিশ পানি থেকে তোলার পরও ঘণ্টাখানেক জীবিত থাকে।
ক্যানভাস: বাংলা রসনায় আপনার অবদান?
ইলিশ: অনেক। প্রায় ৫০টি পদ্ধতিতে ইলিশ রান্না হয় বাংলায়। ভাপে, সেদ্ধ করে, ভেজে, কলাপাতায় মুড়ে—আরও কতভাবে! শুঁটকি করেও খায় অনেকে। সর্ষে ইলিশ, ইলিশ পাতুরি, ভাপা ইলিশ, কড়া ভাজা, দোপেয়াজা, ঝোল-ঝোল করেও খায় কেউ কেউ। কচু দিয়ে ঘণ্টও হয়। ইলিশ-পোলাও বাঙালির খুব পছন্দ। তা ছাড়া বাঙালির বিয়েশাদি ও উৎসব পার্বণে আমাদের ব্যাপক কদর।
ক্যানভাস: আপনার পুষ্টিমান?
ইলিশ: মোটামুটি সবই আছে। আমার ১০০ গ্রামে ফ্যাট মিলবে ১৯.৪ গ্রাম, আয়রন ২ মিলিগ্রাম, শর্করা ২.৯ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৮০ মিলিগ্রাম, প্রোটিন ২১.৮ গ্রাম, মিনারেল ২.২ গ্রাম, পটাশিয়াম ২৮০ মিলিগ্রাম ও ২৭৩ ক্যালরি। আমি ওমেগা ৩ ফ্যাটও দিই। এটি হার্টের রোগ ও ক্যানসার নিরাময় করতে পারে।
ক্যানভাস: আপনার এত গুণ। এর জন্য কোনো অর্জন?
ইলিশ: একটা অর্জন অবশ্য আছে। আমি বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে ২০১৭ সালে স্বীকৃতি পেয়েছি।
ক্যানভাস: পয়লা বৈশাখে আপনার পরিকল্পনা?
ইলিশ: লুকিয়ে থাকা। হা হা হা।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top