skip to Main Content

স্বাদশেকড় I পান্তা পাঁচালি

খাবারটি কারও কাছে স্বাদের, কারও মুখে আবার রোচে না। অতীতে সাধারণ খাবার হিসেবে থাকলেও সংস্কৃতির বদৌলতে এখন তা বিশেষ দিনে বহু মানুষের পাতে ওঠে। পান্তার উদ্ভব বেশ প্রাচীন বলেই ধারণা

বৈশাখের প্রথম দিনেই খাদ্যের মেনুতে জায়গা পায় পান্তা। সারা বছর মুখে যিনি পান্তা তোলেন না, এ দিনে তিনিও একটু চেখে দেখেন। শুধু কি তাই, রীতিমতো চড়া দামে কিনে খান অনেকে। বাঙালি সংস্কৃতি ও নববর্ষ উদযাপনে খাবারটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। নববর্ষের ইতিহাস কিছুটা খুঁজে পাওয়া গেলেও পান্তা উদ্ভবের হদিস হাতড়ে মেলে না। কিছু অনুমান ও মিথে ভর করে পান্তার শিকড়ে পৌঁছাতে হয়।
পান্তা যেহেতু ভাতের পদ, তাই এই অঞ্চলের মানুষ চাষাবাদ শুরু করার ও ভেতো হয়ে ওঠার পরপরই সেটির উদ্ভব হওয়া সমীচীন। তাই পান্তাভাতের সুলুক সন্ধানে ফিরে তাকাতে হয় অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীর সভ্যতার দিকে। মানে ৫ থেকে ৬ হাজার বছর আগে। নদীবিধৌত এই অঞ্চলের মানুষদের ভাত খাওয়ার অভ্যাস এবং ধানকেন্দ্রিক সংস্কৃতি মূলত তাদেরই দান। এর আগে এখানকার বাসিন্দারা শিকার-সংগ্রাহক ছিলেন বলেই অনুমান করা হয়। ইন্দোচীন থেকে আসাম হয়ে তৎকালীন ভারত-বাংলায় প্রবেশ করেছিলেন অস্ট্রিকরা। তখন এদিকে ছিল ‘নেগ্রিটো’ জাতির বাস। অস্ট্রিকরা এই নেগ্রিটোদের তাড়িয়ে এখানে থিতু হন। বিতাড়িতরা কৃষিকাজ জানতেন না। তবে অস্ট্রিকরা জানতেন। তারাই চাষকৌশল এনেছিলেন এই ভূখণ্ডে। ধারণা করা হয়, জীবিকা হিসেবে শিকার-সংগ্রহ ছেড়ে এই অঞ্চলে ভাত খাওয়ার উৎপত্তি তখনই। ধীরে ধীরে ভাত এখানকার বাসিন্দাদের খাদ্যাভ্যাসে জায়গা করে নেয়। তবে সেকালের মানুষ শুধু চাল সেদ্ধ করে খেয়েই সন্তুষ্ট থাকেননি। স্বাদে ভিন্নতা আনতে এর বিভিন্ন প্রকরণও তৈরি করেছিলেন। আবার খাবারটি সংরক্ষণের তাগিদও ছিল তাদের মধ্যে।
মূলত ধান এমন এক ফসল, যা বারোমাস মিলত না। তাই ফসল ফলার পর তা সংরক্ষণ করার প্রয়োজন পড়ত। তা ছাড়া ধান উৎপাদন বেশ কষ্টসাধ্যও ছিল। ফলে এটিকে অপচয় করা মোটেও সঙ্গত মনে হয়নি সেই সময়ের মানুষদের। ফলে বাড়তি ভাত ফেলে না দিয়ে তা পুনরায় খাওয়ার বন্দোবস্ত করতেই হতো। এতে অবশ্য বারবার রান্নার ঝক্কিও কমত। ভাতের সংরক্ষণ ব্যবস্থার নামই পান্তা। তাই পান্তাভাতকে ‘সংরক্ষিত ভাত’ বললেও খুব একটা ভুল বলা হবে না হয়তো। বাংলা অভিধানও ঠিক তেমনটাই বলে। সেখানে পান্তার মানে লেখা হয়েছে ‘পানিতে ভিজানো বাসি ভাত’। তবে কিছুটা ‘কিন্তু’ রয়ে যায়। বাসি ভাত ভিজিয়ে রাখা হয়, নাকি ভেজানোর পরে তা বাসি হয়, সেই ফিরিস্তি নেই। অবশ্য আধুনিক দৃষ্টিতে বলা চলে, ভালো ভাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে সংরক্ষণ করাই হলো পান্তা। বাসি নয়, বরং বাসি হওয়া থেকে রেহাই দিতেই হয়তো ভাতকে পান্তা করা হতো। যদিও এ সবই অনুমানমাত্র।
এই অঞ্চলের মানুষ পুরোপুরি কৃষিনির্ভর হয়ে ওঠেন ৩ থেকে ৫ হাজার বছর আগে। যদিও কৃষি আবিষ্কৃত হয় আরও আগে। বাঙালি ভেতো হয়ে ওঠেন প্রায় ৫ হাজার বছর আগে। জানা যায়, চাষিদের খাবার জোগাতেই পান্তা ভাতের উদ্ভব হয়েছিল। বিগত রাতের বেঁচে যাওয়া ভাতে পানি দিয়ে সকালে তা খাওয়া হতো। কখনো দুপুরে তা হতো মেঠো চাষিদের আহার। একই ঘটনা দেখা যেত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে। তারাও রাতে বেঁচে যাওয়া ভাতে ডালসহকারে ‘কেডজ্রি’ নামের এক প্রকার খাবার তৈরি করতেন। অর্থাৎ, সে সময়ের সব অঞ্চলের মানুষের মধ্যেই ভাত সংরক্ষণের তাগিদ ছিল। এই ভূখ-ের মানুষের ভাত সংরক্ষণের মূল উপাদান ছিল পানি। এখনো বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পান্তার পানিকে ‘আমানি’ বলে ডাকে।
বাংলা সাহিত্য ও পুরাণের কোথাও কোথাও পান্তার উল্লেখ মেলে। রামায়ণে দেখা যায়, তৎকালীন মুনি-ঋষিরা পোলাও ও নানান তরকারির সঙ্গে পান্তাভাত খেতেন। চণ্ডীমঙ্গলে খাবারটির উল্লেখ রয়েছে। ফুল্লরার বারোমাস্যায় চৈত্রের খরায় অভাবের কারণে পাথরবাটি পর্যন্ত বন্ধক দিতে হয়। তখন দুঃখে ফুল্লরা বলে,
‘দুঃখ কর অবধান দুঃখ কর অবধান।
আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ্যমান।’
বৈষ্ণবেরা রাধাকৃষ্ণকে পান্তা ভোগ দেন। অনেক স্থানে দুর্গাকে দশমীতে পান্তাভাত নিবেদন করা হয়। কোথাও আবার সরস্বতীপূজার শীতল ষষ্ঠীতে পান্তাভাত দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। দেবদেবীদের ভোগে পান্তা নিবেদন থেকে অনুমান করা যায়, এই অঞ্চলে পান্তার চল খুবই প্রাচীন। একেক স্থানে একেক নাম। যেমন আসামে তা পৈত ভাত এবং ওড়িশায় পাখালা ভাত। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে পাখালা ভাত নিবেদন করা হয়। আসামের ‘বোহাগ বিহু’তে পান্তাভাত লাগে। সতেরো শতকের কিছু নথিতে পান্তা ভাতের বর্ণনা মেলে। জানা যায়, মোগল আমলে মুক্তাঙ্গনে শ্রোতারা সংগীত উপভোগকালে যেসব ঐতিহ্যবাহী খাবার খেতেন, সেগুলোর মধ্যে পান্তাভাত ছিল।
ইংরেজ সেনারাও বিপাকে পড়ে পান্তা খেয়েছেন। সিরাজদৌলা কলকাতা আক্রমণ করে বেশ কিছু ইংরেজ সেনা বন্দি করেছিলেন। তবে বিশেষ অনুরোধে তিনি হেস্টিংস নামের এক বন্দিকে ছেড়ে দেন। কিন্তু মুক্তি পেয়েই নবাবের তথ্য পাচারের কাজে লেগে পড়েন ওই সেনা। ফলে নবাব আবারও তাকে বন্দি করতে চান। এই অবস্থায় কৃষ্ণ কান্ত নামের এক দোকানির দোকানে আশ্রয় নেন হেস্টিংস। সেই দোকানি হেস্টিংসকে পান্তাভাত দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন।
বর্তমানে শহুরেদের মাঝে পান্তা খাওয়ার চল খুব একটা নেই। তবে গ্রামাঞ্চলে চাষিসমাজে তা এখনো থাকতে পারে। খাবারটিকে বেশ স্বাস্থ্যবান্ধব বলে থাকেন পুষ্টিবিদেরা।

i ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top