skip to Main Content

তনুরাগ I সুরভিত স্নানে

সাধারণ স্নানাগার রূপান্তরিত হবে ব্যক্তিগত বিলাসী স্পা সেন্টারে। একদম কম খরচে এমন অভিজ্ঞতা সম্ভব সহজ কিছু কৌশলে

চিকিৎসাবিজ্ঞানে তেলের অপরিহার্যতা নিয়ে ১৯৩৭ সালে একটি বই লেখেন ফরাসি রসায়নবিদ ও সুগন্ধিবিদ রেনে-মরিস গেটফঁসে। বইটিতে এই প্রথম ‘অ্যারোমাথেরাপি’ শব্দটি ব্যবহার করেন তিনি। মূলত ক্লান্তি দূর করার কার্যকর পন্থা হিসেবেই অ্যারোমাথেরাপির সুখ্যাতি। নানা সুগন্ধি এসেনশিয়াল অয়েলের সঙ্গে বিভিন্ন উদ্ভিদের নির্যাস ব্যবহার করে শরীর ও মন চাঙা করার এ পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছে অ্যারোমাথেরাপি। মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমানোয় যা এসেনশিয়াল অয়েল থেরাপি নামেও পরিচিত।
তবে বিংশ শতাব্দীতে এসে আভিধানিক নাম পেলেও অ্যারোমাথেরাপি মানুষ ব্যবহার করে আসছে হাজার বছর ধরে। চীন, ভারত, মিসর এবং অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার মানুষ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে প্রাচীনকাল থেকেই সুগন্ধি তেল ব্যবহার করে আসছেন। দশম শতাব্দীতে পারস্যের লোকেরা সুগন্ধি তেল ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। ষোলো শতকে জার্মানিতেও এ ধরনের তেল ব্যবহারের প্রমাণ মেলে। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে সুগন্ধি তেলের ব্যবহার শুরু হয় মূলত উনিশ শতকে, ফ্রান্সে।
মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমানো, ভালো ঘুম হওয়া, মাইগ্রেন ও মাথাব্যথা কমানো, দেহকে ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস-ছত্রাকের আক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেওয়া এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর মতো বেশ কিছু উপকারিতা রয়েছে অ্যারোমাথেরাপির। প্রমাণিত না হলেও অনেক বিশেষজ্ঞের মত, হাঁপানি, অনিদ্রা, স্নায়ুরোগ, বিষণ্নতা, নারীদের পিরিয়ডজনিত সমস্যা, মেনোপজ এমনকি আর্থ্রাইটিস রোগীরাও এই থেরাপির সাহায্যে উপকার পেতে পারেন। বিভিন্ন উপায়ে অ্যারোমাথেরাপি নেওয়া গেলেও বেশ কিছুদিন ধরে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ‘শাওয়ার অ্যারোমাথেরাপি’। দিনভর কাজ শেষে এ থেরাপি সারা দিনের ক্লান্তি দূরে অব্যর্থ।
অ্যারোমাথেরাপি বা এসেনশিয়াল অয়েল নিয়ে যাদের কিছুটা ধারণা আছে, তারা ইউক্যালিপটাসের কথা শুনে থাকবেন। এটি সতেজতা জোগায় শরীর ও মনে। গবেষণায় দেখা গেছে, ইউক্যালিপটাস এসেনশিয়াল অয়েলের অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণ রয়েছে। দেহের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এ উদ্ভিদের নির্যাস। স্নানের সময় থেরাপি হিসেবে এর ব্যবহারও কিন্তু খুব সহজ। স্নানঘরের এক কোনায় এক গোছা ইউক্যালিপটাসের কিছু গুল্ম শুধু ঝুলিয়ে দিলেই চলবে। শাওয়ারের উষ্ণ তাপে এ থেকে বাষ্পাকারে সুগন্ধি নির্গত হবে; যা শাওয়ারে দেবে স্পার অনুভূতি। এ তো গেল কেবল ইউক্যালিপটাসের কথা। কেমন হবে যদি এর সঙ্গে আরও কিছু উদ্ভিদ যোগ করা যায়? এ ক্ষেত্রে শাওয়ার বুকে দারুণ অপশন। এতে ইউক্যালিপটাসের সঙ্গে যোগ করা যায় ল্যাভেন্ডার, রোজমেরি, এমনকি পিপারমেন্টের কাণ্ডও। এতে করে স্নানঘর দেখাবে রুচিশীল, সেই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন উদ্ভিদ থেকে নানা ধরনের উপকারিতাও মিলবে।
শাওয়ার অ্যারোমাথেরাপি নেওয়ার আরও দুটি কার্যকর উপায় হলো শাওয়ার মেল্টস ও শাওয়ার স্প্রে। ‘বাথ বম্ব’-এর কথা শুনে থাকলেও শাওয়ার মেল্টসের কথা জানেন খুব কম মানুষই। সাধারণত বেকিং সোডা, ত্বকের জন্য উপযোগী সাইট্রিক অ্যাসিড এবং পরিমাণমতো এসেনশিয়াল অয়েলের মিশ্রণে তৈরি হয় শাওয়ার মেল্ট। স্নানের সময় শাওয়ারের মেঝেতে এর একটি টুকরো রেখে দিলে সেটি গলে সতেজ এসব উপাদানের মিশ্রণ বাষ্পাকারে মিশে যেতে শুরু করে শাওয়ার স্টিমের সঙ্গে। শাওয়ার মেল্টের চেয়েও সহজ উপায়ে অ্যারোমাথেরাপি নেওয়া যায় শাওয়ার স্প্রে দিয়ে। এসেনশিয়াল অয়েল সমৃদ্ধ ছোট ছোট স্প্রের এই বোতলগুলো সহজেই ব্যবহার্য। এগুলো স্নানঘরের দেয়ালে, কিংবা শাওয়ার হেডে স্প্রে করে নেওয়া যায় অনায়াসে।
শাওয়ার অ্যারোমাথেরাপি নেওয়ার সবচেয়ে সহজ পন্থা হিসেবে ধরা হয় অয়েল ডিফিউজারকে। দীর্ঘ সময় ধরে সতেজ সুগন্ধি ছড়ানো এসব ডিফিউজার অনেকের অন্দরের অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। সাধারণত বাড়ির বসার কিংবা শোবার ঘরে ব্যবহার করা হলেও এ ডিফিউজারগুলো সহজেই ব্যবহার করা যায় স্নানঘরেও। অয়েল ডিফিউজার থেকে সর্বাধিক উপকৃত হওয়ার জন্য গোসল শুরুর ৫ থেকে ১০ মিনিট আগেই ডিফিউজারটি চালু রাখতে হবে। কিন্তু ডিফিউজারে ঠিক কী পরিমাণ এসেনশিয়াল অয়েল যোগ করতে হবে? প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে ৩ থেকে ৫ ফোঁটা এসেনশিয়াল অয়েলকে এ ক্ষেত্রে আদর্শ পরিমাণ ধরা হয়। আদর্শ মান যতই ধরা হোক না কেন, ডিফিউজারে কয় ফোঁটা এসেনশিয়াল অয়েল যোগ হবে, তা নির্ভর করে স্নানঘরের আকারের ওপর। তা ছাড়া ঠিক কোন মাত্রার সুগন্ধিতে স্বচ্ছন্দ, তার ওপরও নির্ভর করবে ডিফিউজারে তেলের ব্যবহার। অয়েল ডিফিউজারের একটি বড় সুবিধা হলো, এতে সব ধরনের তেল ব্যবহার করা যায়। নিশ্বাস-প্রশ্বাস সহজ করার জন্য যেমন ব্যবহার করা যায় ইউক্যালিপটাস ও পিপারমেন্টের মিশ্রণ; তেমনি মানসিক চাপ কমাতে ও ভালো ঘুম হওয়ার জন্য ল্যাভেন্ডারের মিশ্রণ কার্যকর। তা ছাড়া জেসমিন, রোজমেরি, চন্দন, টি ট্রি অয়েল—এসবেরও ডিফিউজার ব্যবহার করা যায় নিজস্ব থেরাপি সেশনে।
শাওয়ার অ্যারোমাথেরাপির আরও এক সহজ বিকল্প হতে পারে অ্যারোমেটিক বডি ওয়াশ। শুনতে অপরিচিত হলেও এর কার্যকারিতা কিন্তু সাধারণ বডিওয়াশের মতোই। চাইলে সহজে বাড়িতে বানিয়ে নেওয়া যায় এটি। ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক সুগন্ধিযুক্ত বডি ওয়াশে পরিমাণমতো এসেনশিয়াল অয়েল যোগ করে। অয়েল ডিফিউজারের মতো এ ক্ষেত্রেও সুগন্ধের মাত্রার ওপর নির্ভর করবে ঠিক কী পরিমাণে এসেনশিয়াল অয়েল যোগ করতে হবে। আলাদা করে বডি ওয়াশ, এসেনশিয়াল অয়েল কিনতে না চাইলে রয়েছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রেডিমেড অ্যারোমেটিক এসেনশিয়াল বডি ওয়াশও।
দীর্ঘ একটি দিনের শেষে সতেজ হবার জন্য যেমন অ্যারোমাথেরাপি কার্যকর, তেমনি ব্যস্ত দিনের শুরুতেও নেওয়া যায় শাওয়ার অ্যারোমাথেরাপি। যারা বিভিন্ন অনুষঙ্গ কেনা বা নিজ হাতে বানানোর পক্ষপাতী নন, তাদের জন্য আরও সহজ উপায় আছে। লেবু, কমলা কিংবা মাল্টার খোসা ফেলে না দিয়ে সেগুলোকে সহজেই থেরাপির অংশ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এগুলোর প্রতিটিই সাইট্রাসের সুগন্ধিযুক্ত। উদ্দীপনা-জাগানিয়া, যা মন-মেজাজকে সজাগ করে তোলে; ইন্দ্রিয়কে জাগিয়ে তুলতেও সাহায্য করে। যাদেরকে খুব সকালে উঠে কাজের জন্য তৈরি হতে হয়, তাদের জন্য অসাধারণ এই থেরাপি। সাইট্রাসজাতীয় খোসা ফ্রিজে সংরক্ষণ করে বেশ কিছুদিন ব্যবহার করা যায় বলে অ্যারোমাথেরাপির এ পন্থাকে বেশ বাজেটসাশ্রয়ী বলা চলে। গোসলের সময় খোসাগুলোকে স্নানঘরের মেঝেতে রাখলে সেগুলো থেকে বাষ্পাকারে সুগন্ধ বেরোতে শুরু করে, যা মনকে উদ্দীপ্ত করতে বাধ্য।
শাওয়ার অ্যারোমাথেরাপির তেমন ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে না জানা গেলেও এ বিষয়ে কিছুটা সতর্ক থাকাই শ্রেয়। এই থেরাপিতে মূল উপাদান হিসেবে এসেনশিয়াল অয়েল ব্যবহার করা হয়। তাই আগে থেকে জেনে নেওয়া ভালো, কোনো উপাদানে এলার্জি আছে কি না। অনেক সময় গর্ভবতী নারীদেরকেও কিছু তীব্র এসেনশিয়াল অয়েল (যেমন: পিপারমেন্ট) ব্যবহারে নিষেধ করেন চিকিৎসকেরা। তাই সব জেনেশুনে, বুঝে শাওয়ার অ্যারোমাথেরাপি নিলে শতভাগ সুফল মিলবে।

i সাদিয়া আফরিন শায়লা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top