skip to Main Content

স্বাদশেকড় I পেঁয়াজ প্রত্ন

বেশ প্রাচীন হার্ব। সাংস্কৃতিক মূল্য ডিঙিয়ে ঔষধি উপাদান। এরপর মুদ্রা। কালের বিবর্তনে বহু রূপ ধারণ করেছে। নানান মিথ ও ইতিহাস জুড়ে রয়েছে এর সঙ্গে

পেঁয়াজকে আড়াআড়ি করে কাটলে তা থেকে বেশ কয়েকটি গোলাকার রিং বেরোয়। বড় পেঁয়াজ হলে চাকতিগুলোও বড় হয়। সেগুলো বেসনে ভাজলে হয় মুখরোচক পদ। বাটার, তিল, কালোজিরা ও ঘি যোগ করলে স্বাদ আরও খোলে। আমাদের দেশে পেঁয়াজের এ ধরনের বড়া খাওয়ার চল কম। কিছু রেস্তোরাঁয় অবশ্য মেলে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার কিছু অঞ্চলে এই পদের কদর তুঙ্গে। এ মাসে হুট করে পেঁয়াজের গোল গোল বড়ার কথা তোলার কারণ, ২২ জুন ‘ন্যাশনাল অনিয়ন রিং ডে’। উল্লিখিত দেশগুলোতে দিনটি ঘটা করে উদযাপিত হয়। সেদিন তারা এ ধরনের পেঁয়াজের বড়া তৈরি করে পরিবারসমেত খান।
অনিয়ন রিং ডে উদযাপনের সূচনালগ্ন তল্লাশি করে খুব একটা জুত করা যায় না। তথ্য অপ্রতুল। তবে জন মোলার্ড নামের একজন রসনা লিখিয়ে তার ‘দ্য আর্ট অব কুকারি মেড ইজি অ্যান্ড রিফাইন্ড’ বইয়ে পদটির উল্লেখ করেছিলেন। ১৮০২ সালে। তখন থেকেই ধীরে ধীরে পেঁয়াজের এই বড়া ভোজনরসিকদের পছন্দের তালিকায় যোগ হয় বলে জানা যায়। সে যা-ই হোক, অনিয়ন রিঙের মূল উপকরণ পেঁয়াজ। সেটি একেবারে ইতিহাসছাড়া নয়। তা নতুন কোনো শস্যও নয়। মিথ তো বটেই, প্রাচীনকালে রাজ-রাজড়াদের পাতও দাপিয়ে বেড়িয়েছে পেঁয়াজ। এমনকি মৃত্যুর পরেও অনেকের পিছু ছাড়েনি; গেছে সঙ্গে, সমাধিতে।
উপকথা হাতড়ে পেঁয়াজের উৎপত্তি বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য মিলেছে। শয়তানকে স্বর্গ থেকে ছুড়ে ফেলার পর তার ডান পা পৃথিবীর যে স্থানে পড়েছিল, সেখানেই জন্মেছে পেঁয়াজ। তুরস্কের লোকশ্রুতিতে পেঁয়াজের উৎপত্তির বিষয়টি এভাবেই বর্ণিত হয়েছে। নন-সেমিটিক ধর্মের কিছু মিথেও আছে পেঁয়াজের উৎপত্তিকথন। ভগবান বিষ্ণু যখন মোহিনী অবতাররূপে দেবতাদের অমৃত দেওয়ার জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন, তখন রাহু ও কেতু নামে দুজন অসুর লুকিয়ে দেবতাদের সারিতে বসেছিলেন। এরপর ভগবান উভয়ের মুখে অমৃত দেন। ঠিক তখনই চন্দ্র ও সূর্যদেব ভগবানকে জানান, ওই দুজন অসুর। এ কথা শুনে তখনই তিনি রাহু ও কেতুর মাথা কাটেন। অমৃত তখনো তাদের গলা বেয়ে পাকস্থলীতে ঢুকতে পারেনি। মুখেই ছিল। ফলে তা বেরিয়ে মাটিতে পড়ে। দুই অসুরের গলা থেকে ভূপতিত রক্তমেশা অমৃত বিন্দু থেকেই পেঁয়াজ ও রসুনের উৎপত্তি। তা ছাড়া বৈষ্ণবধর্ম মতে, একজন ঋষির গোমেধ যজ্ঞের আয়োজনকালীন তার স্ত্রী গর্ভবতী হন। সেই প্রসূতি গরুর মাংসের প্রতি লোভাতুর হয়ে স্তূপ থেকে এক টুকরা মাংস লুকিয়ে ফেলেন। যজ্ঞ শেষে ঋষি মন্ত্র পড়ে মাংসগুলো একত্র করে আবারও বাছুর সৃষ্টিতে মনোনিবেশের সময় দেখা গেল, সেটির শরীরে এক টুকরা মাংস কম পড়েছে। প্রসূতি বুঝতে পারলেন, ঋষির সন্দেহের তীর তার দিকেই। ফলে তিনি মাংসের টুকরাটি দূরে ছুড়ে ফেলেন। সেটি গিয়ে পড়ে কোনো এক মাঠে। ঋষির মন্ত্রবলে ওই মাংসপিণ্ডে প্রাণের সঞ্চার হয়। ফলে নতুন যে বাছুর উৎপন্ন হয়, সেটির মাংস থেকেই জন্মায় পেঁয়াজ।
উপকথা ছেড়ে ইতিহাসে আসা যাক। নির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানা না গেলেও মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার কিছু স্থানে আনুমানিক ৭ হাজার বছর আগে পেঁয়াজ ব্যবহারের নমুনা মিলেছে। তখন ছিল ব্রোঞ্জ যুগ। সেকালের মানব বসতিতে সবজি হিসেবে পেঁয়াজ ব্যবহৃত হতো বলে ধারণা করা হয়। আরেকটি মতে, ইরান ও পশ্চিম পাকিস্তানে প্রথম পেঁয়াজের চাষ হয়েছিল। তা ছাড়া প্রাচীন রোমের ভোজনরসিক ব্যক্তিত্ব এপিসিয়াসের লেখায় প্রথম পেঁয়াজের উল্লেখ মিলেছে। প্রাচীন মিসরের পিরামিড-শ্রমিকদের রান্নায় ছিল এর উপস্থিতি।
ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে কৃষির আবিষ্কার হয়েছে ১২ হাজার বছর আগে। ইতিহাসবেত্তাদের কারও কারও অনুমান, তারও আগে মানুষ পেঁয়াজ খেতে জানতেন। এই ধারণা সত্য হলে পৃথিবীতে পেঁয়াজের বয়স ১২ হাজার বছরের বেশি। আমেরিকান পেঁয়াজ সমিতি জানিয়েছে, প্রাচীন মানুষের তৃষ্ণা মেটাত পেঁয়াজ। অভাবের সময় খাওয়ার জন্য পেঁয়াজ সঞ্চয় করে রাখতেন সেকালের লোকজন।
খাওয়া ছাড়াও সাংস্কৃতিক উপাদান হিসেবে অতীতে পেঁয়াজের উপযোগিতা ছিল। অনন্ত জীবনের প্রতীক ভাবা হতো এটিকে। প্রাচীন মিসরীয়দের কাছে পেঁয়াজ পূজিত হতো। তারা বিশ্বাস করতেন, মরণোত্তর জীবনের জন্য পেঁয়াজ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তাই সমাধিতে তারা পেঁয়াজ দিতেন। ফারাও রাজা চতুর্থ রামেসিসের সমাধি আবিষ্কারের পর দেখা গেছে, তার মমির দুই চক্ষুকোটরে পেঁয়াজ রাখা। মরদেহের নানান অংশেও পেঁয়াজ রাখা হতো। বুক ঢেকে দেওয়া হতো পেঁয়াজ ফুলে। তা ছাড়া মমির কান ও পায়ের পাতাও সজ্জিত হতো পেঁয়াজ দিয়ে। পিরামিডের ভেতরে বিভিন্ন চিত্রকর্মেও এর উপস্থিতি মিলেছে। মিসরীয় যাজকদেরকে ছবিতেও আছে পেঁয়াজ। এর ঝাঁজে মৃত লোকও শ্বাস নেওয়া শুরু করে—এমন ধারণা প্রচলিত ছিল সে দেশে। তাই মিসরীয়রা পেঁয়াজকে জাদুর বস্তু হিসেবে গণ্য করতেন। মিসরের চেয়ে প্রাচীন গ্রিকবাসী পেঁয়াজ ব্যবহারে আরও এগিয়ে ছিলেন। সে দেশে সেই সময়ের ক্রীড়াবিদেরা প্রচুর পেঁয়াজ খেতেন। তারা এর স্বাস্থ্যগুণ সম্পর্কে অবগত ছিলেন। পেশিশক্তি বাড়াতে রোমান গ্লাডিয়েটররা শরীরে পেঁয়াজ মালিশ করতেন বলে জানা যায়। তা ছাড়া দাঁতের ব্যথা ও অনিদ্রা দূর করতে পেঁয়াজ খেতেন রোমান সাধারণ নাগরিকেরা। পম্পেই নগরীতে এর চাষের নমুনা পেয়েছেন প্রত্ন তাত্ত্বিকেরা।
মধ্যযুগের সুপার ফুড ছিল পেঁয়াজ। তখন মুদ্রা হিসেবেও এর ব্যবহার হতো। নানান অনুষ্ঠানে উপহার উপকরণ হিসেবে এর চাহিদা ছিল। ষোড়শ শতাব্দীর দিকে বন্ধ্যাত্ব দূর করার ওষুধ ছিল পেঁয়াজ; পাশাপাশি মাথাব্যথার পথ্যও। সাপের বিষ দূর করা ও চুলপড়া রোধেও ব্যবহৃত হতো। সে সময় আমেরিকান আদিবাসীরা সিরাপ, রং ও ওষুধ প্রস্তুতের জন্য পেঁয়াজ ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। এমনকি রান্নায় হার্ব হিসেবেও তা দেওয়া হতো।
ভারতীয় উপমহাদেশে ষষ্ঠ শতাব্দীতেও পেঁয়াজ ব্যবহারের নজির রয়েছে। তৎকালীন চিকিৎসাগ্রন্থ ‘চরক সংহিতা’য় ওষুধ হিসেবে এর বর্ণনা করা হয়েছে। বর্তমানে ঘরে ঘরে পেঁয়াজ। বাঙালি রসনায় তা এখন যেন অনিবার্য।

 শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top